Tuesday, 13 November 2018

শিলা লিপি - তন্ময়



সাজিয়ে পাথর নানারকম 
যতই উঠি ওপর দিক
পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি
নিস্পৃহ এক শিবালিক।।




তারা লক্ষ্যে অবিচল     
করছে খেলা তোমার    
    চির খেলার ফলাফল,
তুমি লক্ষ্যে অবিচল।।  



গোড়ায় যার পাষাণ সম বাধা 
সে কি করে এত রঙিন হল
তার ভেতরে প্রাণের এত আশা
ধাঁধার মধ্যে বৃহত্তম ধাঁধা।

Thursday, 1 November 2018

ডুয়ার্স সফরনামাঃ পাহাড় থেকে নদী, নদী থেকে পাহাড় - অতনু


অক্টোবর ২২, রাত ৮টা, জয়ন্তী 

রাত্রি আটটা। আমরা দুজন দুটো পাথরের ওপর বসে আছি। সামনে দিয়ে সরবে বয়ে চলেছে জয়ন্তী নদী। পা টাকে একটু সামনে ছুঁড়ে দিলে বা একটু ঝুঁকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেই জলের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। কোজাগরী লক্ষীপূর্ণিমার আগের দিন। আকাশে প্রায় পূর্ণ চন্দ্র। নরম জ্যোৎস্নার আলো ছেয়ে আছে নদীতট জুড়ে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে নদীর পেছনে ছায়া ছায়া পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে ক্যাঁও ক্যাঁও করে ময়ূরের ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু দূরে আরেকটা পাথরের ওপর বসে আছে তন্ময় আর শুক্লা। ওদের যুগল কন্ঠের ছেঁড়া ছেঁড়া সুর শুনতে পাচ্ছি ... তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই ...। পল্লব চুপ করে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বব আর অঞ্জনকে দেখতে পাচ্ছি না। ওরা বোধহয় নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে। পেছন থেকে অংশুমান বলল, "হামিন আস্ত-ও, হামিন আস্ত-ও, হামি আস্ত।" পৃথিবীর বুকে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তো এখানেই। পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, গতকাল ঐগুলোরই কোন একটার মাথায় ছিলাম। লেপচাখা। কালকে পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখেছিলাম নদী কে। আজ নদীর ধারে বসে দেখছি পাহাড় কে।



লেপচাখায় দেখেছিলাম প্রকৃতির আরেক রূপ। আগেরদিন ছিলাম ২৮০০ ফুট উঁচুতে বক্সা ফোর্টের ধারে সূরয ড্রুকপার হোমস্টে তে। সেখান থেকে আরো ৭০০ ফুট চড়াই পাথুরে রাস্তা বেয়ে উঠতে উঠতে যখন ভাবছিলাম, এত কষ্ট করে কিইই বা পাব, তখনই একটা বৌদ্ধ স্তুপ আর অনেকগুলো টিনের চাল দেওয়া কাঠের বাড়ির আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন "ডুয়ার্সের রাণী।" ঠিক যেন একটা ওলটানো বাটির মাথায় এসে দাঁড়ালাম। সবুজ ঘাসের লনের ওপর পেমা ড্রুকপার কাঠের হোমস্টে। বাটির তিন ধারে গেলে দেখা যাবে ধাপে ধাপে জঙ্গল নেমে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। তারপর বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। তার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকগুলো নদী। অন্য ধারে আরো উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ঐ পাহাড় পেরোলেই ভূটান। আকাশে ধূসর মেঘ। মেঘের ফাঁক দিয়ে নরম রোদ্দুর এসে পড়ছে সবুজ ঘাসের ওপর। লেপচাখার মাঠে খেলবে বলে পল্লব কুড়ি টাকা দিয়ে একটা রবারের বল কিনেছিল। সেটা ওপর থেকে ফেলতেই পেমাজির একরত্তি ছেলে সেটা বগলদাবা করে ধাঁ। মাঠের ওপর চেয়ার টেবিল পেতে মধ্যাহ্নভোজের পর সবাই ঘরে গিয়ে নাসিকা সঙ্গীত শুরু করল। খালি আমি আর শ্রীরূপা হোমস্টের বারান্দায় বসে রইলাম। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন সূযযিমামা। ক্রমে তাঁরও বেলা বয়ে এলো। ধীরে ধীরে আকাশ রাঙা করে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে তিনি নামতে না নামতেই অন্যদিক দিয়ে উদয় হলেন চাঁদমামা। তারপর হোমস্টের বারান্দায় আড্ডা গল্প খেলা, পেমাজির স্ত্রীর করা মাংসের ঝোল আর ভাত দিয়ে নৈশাহার, তারপর আবার আড্ডা গল্প সেরে কখন ঘুমোলাম তা আর মনে পড়ে না।




অনির্বানের ফোনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। এবারে সশরীরে আসতে না পারলেও অনির্বান সবসময়েই আমাদের সঙ্গে আছে। বলল, বেশী রাত করিস না, এখানে বুনো হাতি বেরোতে পারে। আমরা উঠে পড়লাম। বব, অঞ্জন, অংশুমানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি পাঁচজন রওনা দিলাম প্রজাপতি হোমস্টে-র দিকে। সকালে লেপচাখা থেকে ট্রেক করে সাঁওতালবাড়িতে নেমে অসীমের গাড়িতে করে দুপুরবেলায় এখানেই এসে উঠেছি আমরা। হোমস্টের প্রোপাইটার কমল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সদা তৎপর, অতিথিদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। বিকেলবেলায় নদীর ধারে বেরোচ্ছি শুনে মুড়ি, চানাচুর, ভেজ পকোড়া আর বড় কাপে কড়া করে চমৎকার লিকার চা খাইয়ে ছেড়েছেন। বব রা এলো খানিক পরে। ওরা নদীর ওপারে গিয়ে শুয়েছিল। তারপর কোন অচেনা জানোয়ারের ডাক শুনে পালিয়ে এসেছে। লাভের লাভ যেটা হয়েছে, অঞ্জন তার সদ্য কেনা হাওয়াই চটিটি নদী পেরোতে গিয়ে খুইয়ে এসেছে। সাধের টুপিটা সাঁওতালবাড়ির মোমোর দোকান থেকে উদ্ধার করতে পারলেও জয়ন্তী অতটা ভদ্র নয় বলাই বাহুল্য।



অক্টোবর ২৩, সকাল ৬টা, জয়ন্তী 

ভেবেছিলাম ভোরবেলায় নদীর ধারে চলে আসবো, সূর্যোদয়ের আগেই। কিন্তু গতরাত্রেও আগের দিনের মতই গল্প আড্ডায় শুতে দেরি হয়ে গেছে। সবাইকে ওঠানো গেল না। আমি, শ্রীরূপা আর অংশুমান যখন নদীর ধারে এলাম তখন ৬টা বেজে গেছে। সূযযিমামা পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঠে পড়েছেন। ভোরের আলোয় জয়ন্তী তার সৌন্দর্যকে মেলে দিয়েছে অন্য চেহারায়। নদী খাতের খুব বেশী হলে পাঁচ ভাগের একভাগ দিয়ে জল বইছে। নানা রঙের নুড়ি পাথর ছড়ানো। নদীর পেছনের পাহাড়, পাহাড়ের তলায় জঙ্গল এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নদীতীরে আর কেউ নেই। খালি একজন একটা বড় গাড়ি ধুচ্ছেন নদীর জলে। খানিক বাদে আরেকজন এসে নদীর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যবন্দনা শুরু করলেন। অংশুমান তার ক্যামেরা দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য লেন্সবন্দী করতে ব্যস্ত। আমরা পায়ে পায়ে নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম। কয়েকটা জিপসি দেখলাম যাত্রীসহ জলের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল সাফারি করতে। ওদিকে তন্ময় শুক্লা চলে এসেছে। তন্ময় নুড়ি ওপর নুড়ি সাজিয়ে শিল্পরচনায় ব্যস্ত। আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ব্রেকফাস্ট করে জলদাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হব।

অক্টোবর ২৩, দুপুর ১২টা, জয়ন্তী পোখরি লেক 

আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি পোখরি লেকের ধারে। বব লেকের পাড়ে বসে মুঠো করে জলে মুড়ি ছুঁড়ে দিচ্ছে আর সেই মুড়ি খাওয়ার জন্য হাঁ করে ছুটে আসছে অজস্র মাগুর মাছ। হঠাৎ আমাদের গাইড গৌরাঙ্গ দে মহাশয় ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললেন। লেকের পাড়ের একটা গাছ উপড়ে ফেলা রয়েছে জলের ওপর। গাছের মূলের শেকড়ের দিকটায় অনেকটা মুড়ি ফেলা রয়েছে। আর গুঁড়ির যেখানটা জলে ডুবে আছে সেখান দিয়ে আস্তে আস্তে উঠছে একটা কচ্ছপ। কিন্তু এ কী! কচ্ছপটা উঠতে যেতেই আশপাশ থেকে কয়েকটা মাগুর মাছ তার পা টেনে ধরল। খানিক টানাটানির পর কচ্ছপটা গুঁড়ির ওপর উঠতে সমর্থ হল। পল্লব গম্ভীর মুখে ফিসিফিস করে বলল, "সার্ভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট"। গুটিগুটি পায়ে সে যখন মুড়ির কাছে এলো তখন প্রাণীবিদ অঞ্জন আর ডক্টর অংশুমান আবিষ্কার করল যে প্রাণীটার লিপ্তপদ নেই। অতএব এটা tortoise, turtle নয়। অঞ্জন বলল, "মাগুরমাছ, বা কচ্ছপ, মুড়ি কারোরই স্বাভাবিক খাদ্য নয়। মানুষ মুড়ি দিয়ে এদের অভ্যেস পালটে দিয়েছে।" গৌরাঙ্গবাবু আসার সময়েই বলছিলেন, এটা একটা ধর্মস্থান, পুজোর বেদী থাকলেও এখানকার আসল দেবতারা আছেন মৎস ও কূর্ম অবতার রূপে। ভূটান থেকে বৌদ্ধরা এসে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নানারকম খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে। কিন্তু মুড়ি ছাঁড়া কোনটাই এনাদের পেটে সহ্য হয় না। তাই অন্য খাবার দেওয়া এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। 



আজকের হাঁটাটা একেবারেই আনএক্সপেক্টেড ছিল। প্রজাপতি হোমস্টে থেকে বেরিয়ে অসীম যখন বলল জলদাপাড়া যাওয়ার আগে পোখরি লেক ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো, তখন ভেবেছিলাম গাড়ি থেকে নেমে লেক দেখে বেরিয়ে যাব। তা না হয়ে যখন চেকপোস্ট থেকে গাইড নিতে হল এবং সেই গাইড গৌরাঙ্গবাবু খানিক এগিয়েই বললেন এবার উঠতে হবে তখন গালে একগাল মাছি। যদিও লেপচাখা ট্রেক করে আসার পর এটা কিছুই না, তবু মানসিক প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে ফের ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে শুনতে, বুনো ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে, বাহারি প্রজাপতিদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে পাহাড়ে উঠে পড়লাম। এখানে বুনো হাতি ও লেপার্ড আছে। লেপার্ড গরু ছাগলের খোঁজে গ্রামে হানা দিলেও মানুষকে তেমন ঘাঁটায় না। তবে গৌরাঙ্গবাবুর কথায় সবচেয়ে খতরনাক জানোয়ার হচ্ছে বুনো কুকুর বা ধোল। ৩৫ টা ঢোলের  একটা দল ঐ এলাকাতেই আছে। এদের কারোরই দেখা অবশ্যি মেলেনি। মাঝে বিপত্তি বলতে ছবি তুলতে গিয়ে অংশুমানের পপাত ধরণীতল হওয়া।

পোখরি লেক দেখে পাহাড় থেকে নেমে আবার অসীমের গাড়িতে বসলাম। এবার ফাইনালি ডেস্টিনেশন জলদাপাড়া।

 
 

প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরঃ

কমল বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রজাপতি হোমস্টে) - 9733341594/ 9002232665
দীপঙ্কর দে (ম্যাজেস্টিক হিমালয়ান) - 9733828481

বক্সা দুর্গ

বক্সা দুর্গ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এটা কারা তৈরী করেছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ভূটান ও কোচবিহার রাজ্যের সংঘাতের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই দুর্গ। ১৭৭২ সালে ভুটানরাজ বক্সাদুয়ার দিয়ে কোচবিহার আক্রমণ করলে কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শরণাপন্ন হয়। ব্রিটিশ বাহিনী ভোটসেনা দের বিতাড়িত করলেও পরে তিব্বতের মধ্যস্থতায় ব্রিটিশরা বক্সার ওপর ভূটানের অধিকার মেনে নেয়। কিন্তু পরে ভূটান ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে বিরোধ ফের মাথাচাড়া দেয়। ১৮৬৩ তে ব্রিটিশ দূত ইডেন ভূটান রাজসভায় চূড়ান্ত লাঞ্ছিত হয়। পরের বছর দ্বিতীয় ভূটান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং কর্ণেল ওয়াটসনের নেতৃত্বে ইংরেজরা বক্সা দুর্গ সহ সমগ্র ডুয়ার্স দখল করে। ব্রিটিশরা বাঁশ ও কাঠের তৈরী কাঠামো ভেঙে ইঁট পাথর দিয়ে পুনর্গঠিত করে। বিংশ শতকে বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধাক্কায় অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশরা এই দুর্গে একটা বন্দীশালা বানায়। উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবীদের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুর্গম পাহাড়ে নির্বাসন দেওয়া। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নলিনীকিশোর গুহ, ত্রিদিব চৌধুরী, প্রমোদ দাশগুপ্ত সহ অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স ইত্যাদি গ্রুপের বহু বিপ্লবীকে এই দুর্গে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৩১এর ২৫শে বৈশাখ বক্সা দুর্গের রাজবন্দীরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন এবং কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠান৷ রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাভিনন্দন জানিয়ে লিখে পাঠান,
"অমৃতের পুত্র মোরা" কাহারা শুনিল বিশ্বময়!
আত্মনিবেদন করি, আত্মারে কে জানিল অক্ষয়;
ভৈরবের আনন্দেরে
দুঃখেতে জিনিল কে রে,
বন্দীর শৃঙ্খলছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয়৷৷
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আগে গান্ধীজি দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন বন্দীদের সঙ্গে আলোচনা করতে৷ স্বাধীনতার পর নেহরু সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলে আবদুল হালিম, বিজয় মোদক, চারু মজুমদার, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অনেক কমিউনিষ্ট সংগঠক এখানে অন্তরীত হন। ১৯৫১ সালে এই বন্দীশিবির বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৫৯ এ তিব্বতে দলাই লামার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর বেশ কিছু তিব্বতি শরণার্থী এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন অবশ্য শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তবে রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত বন্দীদের শুভেচ্ছাবার্তা আর রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাভিনন্দন দুটো পাথরের ফলকে খোদাই করা আছে৷

Tuesday, 30 October 2018

ডুয়ার্স সফরনামা: প্রথম দিনের কাহন - শ্রীরূপা

গতবছর উড়িষ্যা ট্রিপে বসেই ঠিক হয়েছিল এবছরের ডেস্টিনেশন ডুয়ার্স। প্রস্তাবটা অনির্বানই দিয়েছিলো। চল এবার ডুয়ার্স যাই, বক্সা-লেপচাখা-জয়ন্তী আর ফেরার পথে কোনো একটা জঙ্গল। প্রস্তুতি শুরু হলো সেই মতন। প্রতিবারই যা হয় - কটা টিকিট কাটা হবে সেই নিয়ে টানাপোড়েন। এই চার মাস আগে টিকিট কাটার গপ্পোটা বড্ড ঝামেলার। তাই মোটামুটি গড়ে হিসেব করে ৯ টা টিকিট কাটা হলো। উত্তরবঙ্গে যাওয়া পাকা ।টিকিট কাটার ঝঞ্ঝাট নিয়ে আমি গপ্পো ফেঁদে বসলাম। (দ্রঃ টিকিটপুরাণ) ফেরার টিকিটের দিনই হলো ঝামেলা। কাঞ্চনকন্যায় ওয়েটিং হয়ে গেলো। কুমার কত্তার সব কাজ একদম যথাযথ হওয়া চাই, তাই কনফার্ম হয়ে যাবে এই আশা রেখেও পরের দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘায় কনফার্ম টিকিট কেটে রাখলো। মাসবদলের সাথে সাথে আমাদের যাওয়ার সদস্য সংখ্যাও পাল্টাতে থাকে। কখনো ৯ থেকে ৭ কখনো বা ৫ আবার কখনো ৬। দীপঙ্কর দা মানে যিনি আমাদের ডুয়ার্সের দিনযাপনের ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ন দায়িত্বে ছিলেন তারও মাথা খেতে থাকি। কখনও বলি ৯ জন যাচ্ছি না ৭ জন, কখনও বলি  ৫ জন কনফার্মই কনফার্ম; আবার যাওয়ার একমাস আগে বলি, একটু ম্যানেজ করে  ৮ জনের ব্যবস্থা করে দাও। কিভাবে যে উনি সবটা অ্যারেঞ্জ করেছিলেন সত্যি জানিনা। যার উদ্যোগে সবটা শুরু হয়েছিলো সেই অনির্বান বাঁধিয়ে বসলো ডেঙ্গু। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। অনিকে ছাড়া পাহাড়ে ঘোরা ভাবাই যায় না।  মেঘলা মনে মেঘের জগতে পারি দিলুম আমরা ৮ জনে।

কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ রইল এখন তোলা 
আড্ডাঠেক এর বন্ধুরা বেরোল গুছিয়ে ঝোলা। 
শাল-শিমূলের ওম ছড়ানো, মেঘের চাদর মাখা 
দু'হাত নেড়ে হাতছানি দেয় বক্সা, লেপচাখা।
স্মৃতির পারদ উঠবে চরে, তেরো নদীর পারে,
ফিরব যখন, আমার শহর, গল্প শোনাস মোরে।

উত্তরবঙ্গ ধরে পৌঁছলাম নিউ কোচবিহারে। রিটারিং রুমে প্রয়োজনীয় প্রাত্যহিক কাজকর্ম মিটিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে বেড়িয়ে এসে খোঁজ লাগলাম গাড়ির। দীপঙ্কর দা সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। গাড়ির ড্রাইভার অসীম ভাই তখন গাড়ির মাথায় সবে লাগেজ বাঁধছে, কোথা থেকে এক মাতাল অটো ওলা এসে হট্টগোল বাঁধালো। টলতে টলতে তার ডিকশনারিতে থাকা যাবতীয় গালাগাল সে আমাদের ড্রাইভারের উদ্দেশ্য নিবেদন করে যেতে থাকলো একের পর এক। কুমারের সবেতেই খিল্লি করার অভ্যেস, সে এগিয়ে বলে, "তোমার একটা ছবি তুলি হ্যাঁ?" যেই না বলা দিব্বি সে পোজ দিতে শুরু করে, কিন্তু ছবি তোলা হতেই সে তার ফটগ্রাফারের উদ্দেশ্যে অ ব ক চ র লাইন লাগিয়ে দেয় এবং বলতে থাকে, "হ্যাঁ হ্যাঁ ফেসবুকের দিবে আর বলবে এই লোকটা গালি দেয়, তাই না?" বলে আবার গালির ফুলঝুরি দিতে দিতে তেড়ে আসে কুমারের ফোন কাড়তে। এই একখান ঝামেলা লেগে যায় আর কি। কোনো রকমে তাকে হটিয়ে ঝপাঝপ গাড়িতে উঠে বসলাম, ওখানকার লোকাল কিছু লোকজন এসেও তাকে পাশে সরিয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। এত মধুর বাক্যবাণ  বোধকরি আর কেউ কখন কুমারকে শোনাতে পারবে না।



যাইহোক, সকালটা এমন খিল্লি দিয়ে শুরু হলে খিল্লির পারা এমনিতেই চড়ে যায়। গপ্পো, আড্ডা, খিল্লি বেজায় জমে উঠেছে,গাড়িও ছুটছে, কিন্তু পেটে এদিকে ছুঁচোরা রীতিমতন প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়েছে। তাদেরকেই শান্ত করতে অসীম ভাইকে বললাম ভালো দেখে একটা খাওয়ার জায়গায় দাঁড় করাতে। সে নিয়ে গিয়ে থামালো ছোট ছোট দুটো দোকানের সামনে। প্রথমটাতে ঢুকতেই তারা বলল সবে দোকান খুলেছে, কোনো খাবারই পাওয়া যাবে না। পাশের টায় হানা দিলুম, তারা অভয় দিলো খাবার-দাবার পাওয়া যাবে, কিন্ত একটু সময় দিতে হবে। ঝপাঝপ করে চরম উৎসাহে ভদ্রলোক আটা মেখে রুটি বানাতে শুরু করে দিলেন। তার সাকরেদ বাটিতে বাটিতে তরকারি সাজাতে লাগলো। সয়াবিনের তরকারি, আলুবেগুনের তরকারি, ডিমের কারি। আমরা তারওপর অর্ডার করলুম ওমলেট। ভদ্রলোক রুটি বানাচ্ছেন বানাচ্ছেন, আমাদের পেটের ছুঁচো গুলো তিনগুন বেগে রেস লাগাচ্ছে। শেষে থাকতে না পেরে বললুম একটা একটা করেই সবাইকে দিন আগে তারপর নয় আরো দেবেন।  যাইহোক রুটি আসতে থাকলো আমাদের মুখও চলতে থাকলো। আবার আটা মাখলেন ভদ্রলোক আবার গরম গরম রুটি। পরম তৃপ্তিতে পেট মন ভরিয়ে যখন ওনাকে জিগেস করলাম কত হলো??? হাত নেড়ে বললেন অত হিসেব নেই, আপনারাই হিসেব করে যা দেয়ার দিন। এই মানুষগুলোকে দেখলে সত্যি মনে হয়, এরকমও বেহিসেবী ব্যবসাদার হয়!!!

গাড়ি ছুটে চলল বক্সা টাইগার রিজার্ভের সাঁওতালবাড়ি জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। টাইগার রিজার্ভে ঢোকার মুখে পারমিট করাতে হয়, মাথা পিছু ১০০ আর গাড়ির জন্য ৩০০। অনুমতিপত্র নিয়ে , জিরো পয়েন্টের খানিকআগেই গাড়ি থামলো একটা তেমাথায়। একজন লোক বড় ছাতা খাটিয়ে একটা ভাঙা টুল আর নড়বড়ে টেবিল নিয়ে বসে রয়েছে দেখলুম, আর তার আসে পাশে ১০-১২ জন এই ১২-১৪ বয়সী ছেলেপুলের ভীড়। অসীম এসে বলল এখান থেকে গাইড নিতে হবে। অংশুমান আর কুমার কত্তা গেলো লেখাজোকার কাজ সারতে, আমরা গেলুম মোমো খেতে। মোমো খেয়ে বাড়িতে ফোন করে দিলুম, পাহাড়ে উঠছি, সামনের দুদিন নো কন্টাক্ট।



কুমার আর অংশু একবার ইশারায় জিগেস করলো পোর্টার লাগবে কিনা, আমি আর শুক্লা একটু টানাপোড়েনে ছিলুম যে ব্যাগ নিয়ে উঠতে পারবো কিনা, বোবো মানে আমাদের বব বলল নো চাপ তোমাদের ব্যাগ আমি বয়ে দেব। আমাদেরও ইগো, সঙ্গে সঙ্গে বললুম না আমাদের ব্যাগ আমরাই বইবো, নো পোর্টার। অসীম ভাই বলল গাড়ী আরো খানিকটা যাবে। তারপর আপনাদের হেঁটে উঠতে হবে। ওই যে গাইড আসছে। গাইডকে দেখে চোখ ছানাবড়া। পুচকে একটা ছেলে নাম নাসিব লেপচা। ক্লাস ৮ এ পড়ে। এখন ছুটি চলছে তাই এই কাজ করছে। এই করেই পড়াশোনা চালায়। ভীষণ ভালো মিষ্টি একটা ছেলে। দিনযাপনের কঠিন কর্কশ লড়াই দিব্বি প্রাণোচ্ছল ভাবে হেসে কাটিয়ে দেয়।

গাড়ি পৌঁছে গেলো জিরো পয়েন্টে। আপন আপন বোঝা নিয়ে শুরু হলো আমাদের পথ চলা। আমরা অনভিজ্ঞ ট্রেকার্স। এর আগের অভিজ্ঞাতা বলতে হিলে থেকে ভার্সে। (দ্রঃ পাহাড়ের ডায়েরি) আমাদের পণ নো তাড়াহুড়ো, ধীরে ধীরে আসতে আসতে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো। আমায় আর শুক্লাকে একখানা করে লাঠি এনে দিলো নাসিব। আসতে আসতে উঠতে থাকলুম। 

এদিকে আরেক বিপত্তি। অঞ্জন তার সাধের টুপিটা ফেলে এসেছে সাঁওতালবাড়ির সেই মোমোর দোকানে। ব্যাপারটা টের পেতেই সে তড়বড়িয়ে আবার নীচে নামল টুপি উদ্ধার করতে। সে টুপি ইতিমধ্যে একজন নিজের মনে করে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে কেত মারতে ব্যস্ত। শেষে মোমোর দোকানের মালকিনের সহায়তায় টুপি উদ্ধার করা গেল। টুপি উদ্ধার করে অঞ্জন যখন বুক চিতিয়ে ওপরে উঠেছে ততক্ষণে নাসিব তার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দৌড় দিয়েছে। ওরা পাহাড়ের ছেলে, একটা ব্যাগ নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে ওঠা ওদের কাছে জলভাত। তবু ঐটুকু বাচ্ছা ছেলের ঘাড়ে বোঝা চাপানোর ইচ্ছে আমাদের কারোরই ছিল না। অঞ্জন জোর করে তার ব্যাগটা কেড়ে নেওয়াতে নাসিবের নজর পড়ল কুমারের সাইড ব্যাগটার দিকে। যেই না ব্যাগটা নামিয়ে রেখে কুমার ছবি তুলতে গেছে ওমনি সেটা বগলদাবা করে দে দৌড়।



প্রকৃতি পরোতে পরোতে কত রূপ লুকিয়ে রাখে পাহাড়ে না উঠলে বোঝাই যায় না। এক একটা মোড় বেঁকছি, প্রত্যেকটা পাকে প্রকৃতি যেন  নিজের এক অদ্ভুত অসামান্য রূপের হাট খুলে নতুন ভাবে ধরা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কি অসাধারণ আরো খানিকটা ওঠার পর মনে হচ্ছে এখানটা আরো অপূর্ব, আরো খানিক যাওয়ার পর মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারেনা। কোনটা, কতটা যে ক্যামেরাবন্দি করবো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। পাহাড়, সবুজে সবুজে ঘীরে থাকা নানা রকম গাছ, দূরে বয়ে যাওয়া নদী আর প্রজাপতি। নানা রকমের প্রজাপতি। তারা অবশ্য ভীষণই ব্যস্ত। আমাদের পাশ দেওয়ার ও সময় নেই তাদের। তাধিং তাধিং করে নেচে নেচে উড়েই চলেছে। (দ্রঃ বক্সা পাহাড়ের প্রজাপতি) আমরা হাটছি, বসছি আবার হাটছি। অঞ্জন,বব, পল্লব, অংশুমান তরতর করে এগোচ্ছে, কোথাও দাঁড়াচ্ছে, আমরা এগোচ্ছি গুটি গুটি পায়ে। একে অন্যকে বুস্ট আপ করছি এবং আমরা নিশ্চিত হচ্ছি এই ভাবে আমরা একদিন এভারেস্টেও চড়ে যেতে পারবো। এইভাবেই ইয়ার্কি, গপ্পো, ছবি তুলতে তুলতে প্রকৃতির হাত ধরে, প্রকৃতির টানে নাসিবকে অনুসরণ করে গিয়ে পৌঁছলাম বক্সা গ্রামে আমাদের মাথা গোজা র ঠাঁইয়ে।

যখন পৌঁছলাম কারেন্ট ছিল না। আবছা অন্ধকারে পায়ে ঠেকলো কাঠের সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে বেশ বড় সর কাঠের দালান। সবাই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লুম। কি অদ্ভুত অনুভূতি ঠিক বলে উঠতে পারবো না। চাঁদনী রাত, জোৎস্না এসে পড়েছে কাঠের বারান্দায়, এতটা উঠে আসতে পেরেছি বলে অসম্ভব আত্মতৃপ্তি, ঘন্টি পোকা ডেকে চলেছে, এক অজানা অচেনা পাহাড়ি গ্রামে আমরা ৮ বন্ধু।

খানিক পরেই কারেন্ট এলো। আমাদের হোস্ট এখানে সুরাজ বলে একটি ছেলে। এই আমাদের পরের দিন লেপচাখা নিয়ে যাবে। প্রবল হাঁটাহাঁটিতে সবারই খিদে পেয়েছিলো। সোনাম দি গরম গরম ডিম ম্যাগী বানিয়ে দিলো খেয়ে দেয়ে আমরা গেলুম একটু ফ্রেশ হতে আর বেশ ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করেছে, তাই গরম জামাকাপড় বের করতে।



সবাই চেঞ্জ করে গরম জামাকাপড় জড়িয়ে এসে বসলাম কাঠের বারান্দায়। সুরাজের কাছে আবদার করলুম চা পকোরার। চলে এলো গরম গরম চা পাকোড়া। তারপর শুরু হলো গানের লড়াই। দুই দল একদলে অঞ্জন,পল্লব, বব, অংশুমান আরেকদলে আমি কুমার শুক্লা আর তন্ময়। জমজমাট হয়ে উঠলো আমাদের গানের আসর, খোলা পরিবেশে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে আমরা গাইতে লাগলাম। ফোনে টাওয়ার নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দায়িত্ব নেই, সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর কোনো তাগিদ নেই ,কোনো তাড়া নেই। অনাবিল আনন্দের একমুঠো মুহূর্ত।

ডাক পড়লো রাতের খাওয়ার, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে রাতের খাওয়া দাওয়া সারলাম। নাঃ আর বারান্দায় বসে আড্ডা মারা যাবে না ঠান্ডাটা বেশ বেড়েছে। আমাদের দুটো ঘর। একটা ঘরে গুটিসুটি মেরে বসলুম সব। শুরু হলো ভূতের গপ্পো। চারিদিক নিঃস্তব্ধ। প্রথমে অঞ্জন, তারপর পল্লবের ভূতের গপ্পে একেবারে জমে ক্ষীর আমাদের পাহাড়ী প্রথম নিশি। খেয়াল হলো ঘড়ি ১.৩০ পার করে দিয়েছে। ঘুমোনোর কারো কোনো ইচ্ছেই নেই। কিন্তু শুতেই হবে, কারণ কাল সকালে আবার বেড়োনো। তাই আর দেরি না করে গপ্পের ঝাঁপি পরের দিনের জন্য তুলে রেখে ঘুমোতে গেলাম।



পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো আমার। সবাই ঘুমোচ্ছে। ঘর থেকে বেড়িয়ে কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে নেমে এলাম। সূর্য সবে উঠছে, যেদিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম। প্রানভরে নিঃস্বাস নিতেই সবুজ বুনো গন্ধে প্রানটা ভরে গেলো। শুধু আমি আর প্রকৃতি, আর কেউ না।সময় এখানেই থমকে থাকুক। কিন্তু তা হবার নয়।

আমরা যেখানে ছিলাম তার সামনেই বক্সা ফোর্ট। সকালের সেই কাঠের বারান্দায় রোদ পোয়াতে পোয়াতে ল্যাদ খেতে খেতে আমরা জলখাবার সেরে আবার হাঁটাহাঁটির জন্য তৈরি হয়ে গেলুম। বক্সা ফোর্টেও একবার হানা দিলুম। বক্সাফোর্ট ঘুরে বক্সফোর্টের সামনেই থাকা একটা গুমটি থেকে অসাধারণ স্কোয়াসের মোমো খেয়ে পাড়ি দিলুম লেপচাখায় উদ্দেশ্যে।
...
কবিতা লেখা আমার কম্ম নয়। ওটি ঝেঁপেছি অঞ্জনের দেয়াল থেকে।


Sunday, 21 October 2018

ডুয়ার্স সফরনামাঃ স্মৃতিসুধায় - অনির্বান

সাল ২০১৪

কাট- ১

গতকাল রাতের ভয়ানক ঝড় আর বৃষ্টির পর আজকের সকালটা আগুনরঙা হয়ে উঠেছে। এইরকম আকাশ বহুদিন দেখিনি। পূবদিকের পাহাড়ে যেন দাবানলের পরশ। এক আদিম সৌন্দর্য। মনে পড়ে যায় রিখটার্সভেল্ডের সেই লুকোনো ভলক্যানোর বর্ণনা । শঙ্করের দেওয়া নাম "মাউন্ট আলভারেজ"। গতরাতটা টেন্টে কাটিয়েছি আমরা চারজন। বক্সা হিলের উপর একটা ধাপে। পৌঁছেছিলাম বিকেলের দিকে। ঘন্টা দেড়েক ট্রেকিং এর পর। তখন থেকেই বর্ষা। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর থেকে বৃষ্টির দমক বাড়ল। সঙ্গে বাজ। যাকে বলে থান্ডার স্টর্ম।

পাহাড়ে বৃষ্টি যেমন সুন্দর তেমনই আতঙ্কের। ঠিক যেন সুন্দর প্রেমিকাটির অবুঝ মন। আমি বরাবর এই তুলনাটাই করি। প্রকৃতি, পাহাড় আর মেয়ে । কোনদিনই নিজেকে আনভেইল করেনা। ঠাওর করাই মুস্কিল যে কি হতে চলেছে।
লাইটনিং আর এই থান্ডারস্টর্ম যে কি তা বুঝেছি বক্সা গিয়ে। শহুরে আমরা কখনো বুঝতে পারিনা এই প্রকৃতির শক্তি। সেই নারীর মতন তাঁর স্বভাব । কোথাও সে বড়ই কৃপণ্ কোথাও বা উজাড় করে দিয়েছে সবটুকু। টেন্টের চারদিকে কড়াৎ কড়াৎ বাজ পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন পরেরটাই টেন্টের উপর আর আমরা জাস্ট রোস্টেড। হাওয়াও তেমন দিচ্ছে। টেন্ট সামলাতে পাথরের টুকরোও চাপাতে হল। আমরা প্রায় সারারাত স্লীপিংব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে রইলাম। পিঠের নীচ দিয়ে বৃষ্টিরজল গড়িয়ে যাচ্ছে। বরফের মতন ঠান্ডা। এইরাত সারাটা জীবন মনে থাকবে...

বক্সা থেকে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য লেপচাখা। হেভ্ন অব ডুয়ার্স। হ্যাঁ বক্সায় আরেকটা জিনিস ছিল মনে রাখার মতন। গতরাতের ডিনারে মোরগের ঝোল। যার স্বাদ আজ অবধি পায়নি কোথাও। ঘন্টাখানেক ট্রেকের পর লেপচাখা পৌঁছলাম।



পাহাড়ের উপর ফ্ল্যাট একটা জায়গা । যেখানে পৌঁছে মনে হয় সত্যি হেভ্ন। সমস্ত ডুয়ার্সকে উপর থেকে দেখা। বিস্তীর্ণ বনভূমি ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত। বনানীর বুক চিড়ে বয়ে চলেছে নদীরা। বালা নদী ,কাটলুং নদী।
সমতলের কিনারায় কাঠের বসার বেঞ্চ করা আছে। পাহাড়ে এরম থাকে। লোকে বলে ভিউপয়েন্ট। আমি ভাবি, আত্মবিশ্লেষনের সিংহাসন। সারাটা দিন বসে থাক আর জীবনের, মনের, মাথার, এক একটা পরত খুলতে থাকা আর পাহাড়ের বিশালতার কাছে ভাসিয়ে দেওয়া। দৈনন্দিন বাচালতা, অফিসের অস্থিরতা, মনের কলুষতা, কাছের জনের হারিয়ে যাওয়া, সব...সব এই বেঞ্চগুলোতে বসে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসা যায়। নিম্নগামী এই মনটাও ঈশ্বরকে ছুঁয়ে আসে পাহাড়ের এই ধারগুলোতে। শুধু এইটুকুর জন্যই লেপচাখায় আসা। এই তো সবচেয়ে বড় পাওনা এই সফরের।


কাট—২ (সাল ২০১৪)

এখন রাত আটটা। চারজন মানে আমি অভিজিৎ দেবজিৎ আর আমাদের দীপঙ্করদা একটা পাথরের উপর বসে আছি। জয়ন্তী রিভারবেডে। হাল্কা চাঁদের আলোয় সমস্তটা ভেসে যাচ্ছে। নদীখাত সাদা হয়ে আছে। গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না নয়, তবু ঘর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছা জাগে। এ এক অনন্য অনুভূতি। দূরের ফরেস্ট থেকে ভেসে অাসছে ময়ুরের ক্যাঁও ক্যাঁও ডাক। হাতির ডাক। শুনলে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শিড়দাঁড়ায়।
সকালে লেপচাখা থেকে ডাউনহিলে খাঁড়াই
বেশ খানিকটা নেমে কাটলুং রিভারবেড দিয়ে প্রায় বাইশ কিলোমিটার ট্রেক করে জয়ন্তীয়ায় পৌঁছেছি বিকেলে।মাঝখানে দেখে নিয়েছি মহাকালের মন্দির। চারশ শিঁড়ি চড়াই । স্টালাগমাইট,স্টালাগটাইটের কারুকার্য...

ফিরে থেকে শুনছি ডেনভারের কান্ট্রী রোড । কি অদ্ভুত মাদকতা এই সুরে! হোমস্টেতে একটু খেয়েই এসে বসেছি এই রিভারবেডে। অরণ্যানীর সামনে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া জয়ন্তী অার তাঁর এই বনভূমির আদিম বৈভব যে কোন নারীর সৌন্দর্যকে বলে বলে দশগোল দেবে। তবু তাঁরাই আমাদের আশ্রয় আর এই জয়ন্তী আমাদের কাছে খোলা হাওয়ার মতন। ফরেস্ট গার্ডের বাঁশিতে ঘোর কাটল। এসে আমাদের বললেন ফিরে যেতে। তখন ঘড়িতে প্রায় দশটা। শুনলাম কয়েকদিন আগেই হাতি ঢুকেছিল জয়ন্তীয়ায়। তাঁদের পালটাই ধারেকাছের ফরেস্টে ঘোরাঘুরি করছে। তাছাড়া চিতার উৎপাতও আছে। রাতের দিকে রিভারবেড সেফ নয়। উঠে পড়লাম আমরা । একরাশ মনে রাখাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। আবার ফিরে আসব এইখানে । কোনো এক বুনো চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে। কথা রইল... জয়ন্তী বলে উঠল,
"একদিন এমন সময় আবার আসিও তুমি আসিবার ইচ্ছা যদি হয়"
দূরের বনভূমি থেকে কোথাও ময়ূর ডেকে উঠল ক্যাঁও ক্যাঁও ক্যাঁও....!!

সাল ২০১৮

কাট টু...



Tuesday, 27 June 2017

পথে চলে যেতে যেতে (২) - অনির্বান

মাসখানেক আগের কথা। মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি, মুর্শিদাবাদ মানে আসলে বহরমপুর হয়ে রঘুনাথগঞ্জ। সকালের হাজারদুয়ারি ধরেছি ব্যারাকপুর থেকে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। অনেকদুরের পথ; আজই ফিরব কিনা ঠিক নেই । হাজারদুয়ারিতে প্রচুর ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা যাতায়াত করেন তাই আশা ছিল ট্রেনটা সময়মতই যায়।
বহরমপুর পৌঁছলাম প্রায় পৌনে এগারোটায়, যথেষ্টই টাইমে। সেখান থেকে আরেক সফর শুরু। বাসের সফর। স্টেশন থেকে চললাম বাসস্ট্যান্ডে। গিয়ে দেখি এক ক্যাওস্। চারিদিকে গাদাগাদা বাস আর হাজারো প্যাসেঞ্জারের হল্লা। কন্ডাক্টররা চেঁচিয়ে চলেছে "রকেট" "রকেট" বলে। এইসব দিকে "রকেট" বাসের চল, মানে নন্-স্টপ অথবা স্বল্প-স্টপ্ , যদিও কপাল খারাপ থাকলে বোঝা যায় রকেটের মহিমা ,কি ভাবে রকেট হাউই হয়ে যায়। এসব জায়গায় যখন যাই, ভাবি আমরা কত ভালোই না আছি। ট্রেন, বাস, অটো, ট্যাক্সি, ওলা, উবের, মেট্রো। পা বাড়ালেই হাজারটা গাড়ি, কত সহজেই চলে যাচ্ছি এখানেওখানে। আর কত্ত মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তার পাশে বসে বসে অপেক্ষা করে থাকে যে কখন একটা "রকেট" এসে বাড়ির ফেরার পথে নিয়ে যাবে। 
আমরাও উঠে পড়লুম একটা রকেটে। যাবে রঘুনাথগঞ্জ হয়ে ফরাক্কার দিকে। বাস ছুটল এন্ এইচ্ থার্টি ফোর ধরে। সত্যি রকেটগতি, ঝাড়া দেড় ঘন্টা লাগল। নামলাম বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে যেতে হবে ভিতরের দিকে।
সেইখানেই পরিচয় হল ভ্যানচালক রেহেমত্ আলির সঙ্গে। ওর ভ্যানেই চড়লাম। বয়স্ক এক মুসলমান। দেখে মনে হল বয়স সত্তরেরও বেশি কিন্তু সুঠাম। আমাদের পেশাগতভাবে কথা বলাটাই দস্তুর যাকে বলে কমিউনিকেশন্ তাই অল্পতর রাস্তা কিন্তু তারমধ্যেই কথা হল কিছু। বলল দীর্ঘ চল্লিশ বছর সে ভ্যান চালাচ্ছে। বাড়িতে কারা আছে জিজ্ঞাসা করায় বলল একসময় আছিল এখন আর কেউ নেই। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে। সক্কলের বে হয়ে গেছে। কিন্তু কেউই আর একসঙ্গে থাকেনা, তবে রেহেমত্ আলির ছেলেমেয়েরা কেউই বাপের মতন ভ্যান চালায়না আর তাঁরা সব ইস্কুলেপড়া। ভাবলাম আমাদের শহুরে নিউক্লিয়ারিটি কি তাহলে আস্তে আস্তে গ্রাম্য সরল সংসারগুলোকেও গিলে খাচ্ছে। রেহেমত্ আলি বলল, তাঁর আর কেউ নেই। তিনদিন আগে তাঁর সারাজীবনের সাথী তাঁর বিবির ইন্তেকাল্ হয়েছে। সে গোর দিয়ে এসেই ভ্যান নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে আর সন্তানরাও ফিরে গেছে নিজের নিজের বাসায়।
সত্যিই পেটের বড়ই দায় আর আমাদের সম্পর্কগুলো বড়ই ঠুনকো। রেহেমত্ আলি বলে উঠল, "কেই বা আর কার আছে?" অাসলে আমাদের কেইবা আছে। সত্যিই আমাদের কেউ নেই। এক হাড়হিম করা সত্যি...
কাজ তাড়াতাড়ি মিটে গেল আমাদের। বিকেল বেলার ফিরতি হাজারদুয়ারি ধরলাম। ফিরতে ফিরতে মনে পড়তে লাগল রেহেমত্ আলির কথাগুলো। আর মনে পড়ল একটা লেখা ভাস্কর চক্রবর্তীর,
"কতো হাজার কোটি বছরের পর হঠাৎ এই জন্ম। --উনি আমার মা ছিলেন! তিনি বাবা; এই ভাই, বোন, দিদিরা! এই দু'একজন বন্ধু! --তারপর শুধুই মিলিয়ে যাওয়া। আবার হাজার হাজার কোটি বছরেও দেখা হবে না কারো সঙ্গে! এই রহস্য আমাকে আজ বড়ো কাছে ডাকছে। "
আমরা তো মিলিয়েই যাই এক অন্ধকারে, হাজার হাজার কোটি কোটি বছরের জন্য তবু এটুকু সময় কেন একসঙ্গে কাটাতে পারিনা আমরা সবাইকে নিয়ে। এ ও এক রহস্য... এক ইউনিভার্সাল মিস্ট্রি।


Thursday, 15 June 2017

পথে চলে যেতে যেতে (১) - অনির্বান

কথাগুলো সেভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি কখনো, হয়তো কোনো দিনই লেখা হয়েও উঠবেনা তবু মনে হয় লিখি না কেন কিছু! হতে পারে সামগ্রিকভাবে কিছু হয়ে উঠলনা, কিন্তু এই যে দুচার কথা যা কিনা আসলে জীবনেরই চলার পথের আখর তাই লিখিনা কেন। কারোর জন্য এসব নয় নিজের জন্যই হয়ত বা বেশি বয়সের কোনো এক আমির জন্যই এই ছোট্টছোট্ট কথা, অনুভূতির কথা, অভিজ্ঞতার কথা, পাওয়া না-পাওয়ার কথা, হারানোর কথা, আরো অনেক কথা অথবা কথার কথা। তেমনই লিখলাম আজ এক মায়ের কথা

বরাবরই আমি বাসে করেই কলকাতা ঘুরে বেড়াই কাজের সূত্রে। ক'দিন আগেও সেরকমই শ্যামবাজার যাচ্ছিলাম বাসে করে। সেভেন্টী এইট বাই ওয়ান। সোজা বি টি রোড মানে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরেই এই যাওয়া। বাস ডানলপ অবধি মোটামুটি গতিতেই যায় ডানলপের পর থেকেই আসল খেলা।সে যাই হোক, বাস ডানলপ ছাড়িয়ে থামল পরের স্টপেজ্ বনহুগলীতে। দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা উঠলেন, সঙ্গে একটি বাচ্ছা ছেলে। স্কুলের পোষাক। ছেলেটি রিটার্ডেড। একদমই জড়। বুঝলাম বনহুগলীতে ন্যাশনাল ইন্স্টিটিউট অব্ অর্থোপেডিক্যাল হ্যান্ডিক্যাপড্ এ পড়ে।

এতটা হয়ত স্বাভাবিক কিন্তু কেন মনে রইল সেই ছেলেটাকে বা তাঁর মাকে ,জানিনা। দেখলাম ছেলেটা বোধশক্তিহীন বাসের সিটে মহিলাটি ছেলেটিকে নিয়ে বসিয়ে দিলেন আর ঘাড়টাকে ধরে রইলেন। মাঝে দুএকবার হাত সরাতে দেখলাম ছেলেটি একদম নেতিয়ে পড়ছে। শক্ত হয়ে বসার ক্ষমতাটুকুও নেই। মুখ দিয়ে কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর মা মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন বারবার । রুমাল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন আর একটাই চেষ্টা করে চলেছেন ঘাড়টাকে সোজা রাখার।

মনে হল এই তো একজন "মা"। ছেলেটি হয়ত কোনোদিনই সুস্থ হবেনা হয়ত খুব বেশি দিন থাকবেও না তবু এই স্নেহ, এই ভালোবাসার নামই "মা"। মহিলাটিও আশা নিয়েই মা হয়েছেন এই সন্তানের। জানিনা এই অনুভব যন্ত্রনার না আনন্দের, নাকি অনুভূতিহীন হয়ে উঠেছেন এই ক'বছরে। তবু তো ছেলেটিকে বহন করে চলেছেন দিনরাত। আরো এইভাবেই সেই মা কাটিয়ে দেবেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছেলেটির সাথে এই আশায় যে একদিন ও সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে।

বাস থেকে ওঁরা নেমে গেল টালাপার্কের কাছে। আমি এগিয়ে গেলাম আরেকটু। মনে মনে ভয় হল । হয়ত এক্সেপশন্ তবুও আমাদের পাওয়াটুকু সবসময় ঠিকঠাক না হলেই .... তবুও এই মা যেন শিখিয়ে দিয়ে গেল যাই হোক্ না কেন "সোজা রাখার" চেষ্টাটুকু তো আমাদের করে যেতেই হবে।