Sunday 21 October 2018

ডুয়ার্স সফরনামাঃ স্মৃতিসুধায় - অনির্বান

সাল ২০১৪

কাট- ১

গতকাল রাতের ভয়ানক ঝড় আর বৃষ্টির পর আজকের সকালটা আগুনরঙা হয়ে উঠেছে। এইরকম আকাশ বহুদিন দেখিনি। পূবদিকের পাহাড়ে যেন দাবানলের পরশ। এক আদিম সৌন্দর্য। মনে পড়ে যায় রিখটার্সভেল্ডের সেই লুকোনো ভলক্যানোর বর্ণনা । শঙ্করের দেওয়া নাম "মাউন্ট আলভারেজ"। গতরাতটা টেন্টে কাটিয়েছি আমরা চারজন। বক্সা হিলের উপর একটা ধাপে। পৌঁছেছিলাম বিকেলের দিকে। ঘন্টা দেড়েক ট্রেকিং এর পর। তখন থেকেই বর্ষা। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর থেকে বৃষ্টির দমক বাড়ল। সঙ্গে বাজ। যাকে বলে থান্ডার স্টর্ম।

পাহাড়ে বৃষ্টি যেমন সুন্দর তেমনই আতঙ্কের। ঠিক যেন সুন্দর প্রেমিকাটির অবুঝ মন। আমি বরাবর এই তুলনাটাই করি। প্রকৃতি, পাহাড় আর মেয়ে । কোনদিনই নিজেকে আনভেইল করেনা। ঠাওর করাই মুস্কিল যে কি হতে চলেছে।
লাইটনিং আর এই থান্ডারস্টর্ম যে কি তা বুঝেছি বক্সা গিয়ে। শহুরে আমরা কখনো বুঝতে পারিনা এই প্রকৃতির শক্তি। সেই নারীর মতন তাঁর স্বভাব । কোথাও সে বড়ই কৃপণ্ কোথাও বা উজাড় করে দিয়েছে সবটুকু। টেন্টের চারদিকে কড়াৎ কড়াৎ বাজ পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন পরেরটাই টেন্টের উপর আর আমরা জাস্ট রোস্টেড। হাওয়াও তেমন দিচ্ছে। টেন্ট সামলাতে পাথরের টুকরোও চাপাতে হল। আমরা প্রায় সারারাত স্লীপিংব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে রইলাম। পিঠের নীচ দিয়ে বৃষ্টিরজল গড়িয়ে যাচ্ছে। বরফের মতন ঠান্ডা। এইরাত সারাটা জীবন মনে থাকবে...

বক্সা থেকে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য লেপচাখা। হেভ্ন অব ডুয়ার্স। হ্যাঁ বক্সায় আরেকটা জিনিস ছিল মনে রাখার মতন। গতরাতের ডিনারে মোরগের ঝোল। যার স্বাদ আজ অবধি পায়নি কোথাও। ঘন্টাখানেক ট্রেকের পর লেপচাখা পৌঁছলাম।



পাহাড়ের উপর ফ্ল্যাট একটা জায়গা । যেখানে পৌঁছে মনে হয় সত্যি হেভ্ন। সমস্ত ডুয়ার্সকে উপর থেকে দেখা। বিস্তীর্ণ বনভূমি ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত। বনানীর বুক চিড়ে বয়ে চলেছে নদীরা। বালা নদী ,কাটলুং নদী।
সমতলের কিনারায় কাঠের বসার বেঞ্চ করা আছে। পাহাড়ে এরম থাকে। লোকে বলে ভিউপয়েন্ট। আমি ভাবি, আত্মবিশ্লেষনের সিংহাসন। সারাটা দিন বসে থাক আর জীবনের, মনের, মাথার, এক একটা পরত খুলতে থাকা আর পাহাড়ের বিশালতার কাছে ভাসিয়ে দেওয়া। দৈনন্দিন বাচালতা, অফিসের অস্থিরতা, মনের কলুষতা, কাছের জনের হারিয়ে যাওয়া, সব...সব এই বেঞ্চগুলোতে বসে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসা যায়। নিম্নগামী এই মনটাও ঈশ্বরকে ছুঁয়ে আসে পাহাড়ের এই ধারগুলোতে। শুধু এইটুকুর জন্যই লেপচাখায় আসা। এই তো সবচেয়ে বড় পাওনা এই সফরের।


কাট—২ (সাল ২০১৪)

এখন রাত আটটা। চারজন মানে আমি অভিজিৎ দেবজিৎ আর আমাদের দীপঙ্করদা একটা পাথরের উপর বসে আছি। জয়ন্তী রিভারবেডে। হাল্কা চাঁদের আলোয় সমস্তটা ভেসে যাচ্ছে। নদীখাত সাদা হয়ে আছে। গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না নয়, তবু ঘর ছেড়ে পালাতে ইচ্ছা জাগে। এ এক অনন্য অনুভূতি। দূরের ফরেস্ট থেকে ভেসে অাসছে ময়ুরের ক্যাঁও ক্যাঁও ডাক। হাতির ডাক। শুনলে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শিড়দাঁড়ায়।
সকালে লেপচাখা থেকে ডাউনহিলে খাঁড়াই
বেশ খানিকটা নেমে কাটলুং রিভারবেড দিয়ে প্রায় বাইশ কিলোমিটার ট্রেক করে জয়ন্তীয়ায় পৌঁছেছি বিকেলে।মাঝখানে দেখে নিয়েছি মহাকালের মন্দির। চারশ শিঁড়ি চড়াই । স্টালাগমাইট,স্টালাগটাইটের কারুকার্য...

ফিরে থেকে শুনছি ডেনভারের কান্ট্রী রোড । কি অদ্ভুত মাদকতা এই সুরে! হোমস্টেতে একটু খেয়েই এসে বসেছি এই রিভারবেডে। অরণ্যানীর সামনে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া জয়ন্তী অার তাঁর এই বনভূমির আদিম বৈভব যে কোন নারীর সৌন্দর্যকে বলে বলে দশগোল দেবে। তবু তাঁরাই আমাদের আশ্রয় আর এই জয়ন্তী আমাদের কাছে খোলা হাওয়ার মতন। ফরেস্ট গার্ডের বাঁশিতে ঘোর কাটল। এসে আমাদের বললেন ফিরে যেতে। তখন ঘড়িতে প্রায় দশটা। শুনলাম কয়েকদিন আগেই হাতি ঢুকেছিল জয়ন্তীয়ায়। তাঁদের পালটাই ধারেকাছের ফরেস্টে ঘোরাঘুরি করছে। তাছাড়া চিতার উৎপাতও আছে। রাতের দিকে রিভারবেড সেফ নয়। উঠে পড়লাম আমরা । একরাশ মনে রাখাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। আবার ফিরে আসব এইখানে । কোনো এক বুনো চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে। কথা রইল... জয়ন্তী বলে উঠল,
"একদিন এমন সময় আবার আসিও তুমি আসিবার ইচ্ছা যদি হয়"
দূরের বনভূমি থেকে কোথাও ময়ূর ডেকে উঠল ক্যাঁও ক্যাঁও ক্যাঁও....!!

সাল ২০১৮

কাট টু...



No comments:

Post a Comment