Tuesday, 27 June 2017

পথে চলে যেতে যেতে (২) - অনির্বান

মাসখানেক আগের কথা। মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি, মুর্শিদাবাদ মানে আসলে বহরমপুর হয়ে রঘুনাথগঞ্জ। সকালের হাজারদুয়ারি ধরেছি ব্যারাকপুর থেকে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। অনেকদুরের পথ; আজই ফিরব কিনা ঠিক নেই । হাজারদুয়ারিতে প্রচুর ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা যাতায়াত করেন তাই আশা ছিল ট্রেনটা সময়মতই যায়।
বহরমপুর পৌঁছলাম প্রায় পৌনে এগারোটায়, যথেষ্টই টাইমে। সেখান থেকে আরেক সফর শুরু। বাসের সফর। স্টেশন থেকে চললাম বাসস্ট্যান্ডে। গিয়ে দেখি এক ক্যাওস্। চারিদিকে গাদাগাদা বাস আর হাজারো প্যাসেঞ্জারের হল্লা। কন্ডাক্টররা চেঁচিয়ে চলেছে "রকেট" "রকেট" বলে। এইসব দিকে "রকেট" বাসের চল, মানে নন্-স্টপ অথবা স্বল্প-স্টপ্ , যদিও কপাল খারাপ থাকলে বোঝা যায় রকেটের মহিমা ,কি ভাবে রকেট হাউই হয়ে যায়। এসব জায়গায় যখন যাই, ভাবি আমরা কত ভালোই না আছি। ট্রেন, বাস, অটো, ট্যাক্সি, ওলা, উবের, মেট্রো। পা বাড়ালেই হাজারটা গাড়ি, কত সহজেই চলে যাচ্ছি এখানেওখানে। আর কত্ত মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তার পাশে বসে বসে অপেক্ষা করে থাকে যে কখন একটা "রকেট" এসে বাড়ির ফেরার পথে নিয়ে যাবে। 
আমরাও উঠে পড়লুম একটা রকেটে। যাবে রঘুনাথগঞ্জ হয়ে ফরাক্কার দিকে। বাস ছুটল এন্ এইচ্ থার্টি ফোর ধরে। সত্যি রকেটগতি, ঝাড়া দেড় ঘন্টা লাগল। নামলাম বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে যেতে হবে ভিতরের দিকে।
সেইখানেই পরিচয় হল ভ্যানচালক রেহেমত্ আলির সঙ্গে। ওর ভ্যানেই চড়লাম। বয়স্ক এক মুসলমান। দেখে মনে হল বয়স সত্তরেরও বেশি কিন্তু সুঠাম। আমাদের পেশাগতভাবে কথা বলাটাই দস্তুর যাকে বলে কমিউনিকেশন্ তাই অল্পতর রাস্তা কিন্তু তারমধ্যেই কথা হল কিছু। বলল দীর্ঘ চল্লিশ বছর সে ভ্যান চালাচ্ছে। বাড়িতে কারা আছে জিজ্ঞাসা করায় বলল একসময় আছিল এখন আর কেউ নেই। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে। সক্কলের বে হয়ে গেছে। কিন্তু কেউই আর একসঙ্গে থাকেনা, তবে রেহেমত্ আলির ছেলেমেয়েরা কেউই বাপের মতন ভ্যান চালায়না আর তাঁরা সব ইস্কুলেপড়া। ভাবলাম আমাদের শহুরে নিউক্লিয়ারিটি কি তাহলে আস্তে আস্তে গ্রাম্য সরল সংসারগুলোকেও গিলে খাচ্ছে। রেহেমত্ আলি বলল, তাঁর আর কেউ নেই। তিনদিন আগে তাঁর সারাজীবনের সাথী তাঁর বিবির ইন্তেকাল্ হয়েছে। সে গোর দিয়ে এসেই ভ্যান নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে আর সন্তানরাও ফিরে গেছে নিজের নিজের বাসায়।
সত্যিই পেটের বড়ই দায় আর আমাদের সম্পর্কগুলো বড়ই ঠুনকো। রেহেমত্ আলি বলে উঠল, "কেই বা আর কার আছে?" অাসলে আমাদের কেইবা আছে। সত্যিই আমাদের কেউ নেই। এক হাড়হিম করা সত্যি...
কাজ তাড়াতাড়ি মিটে গেল আমাদের। বিকেল বেলার ফিরতি হাজারদুয়ারি ধরলাম। ফিরতে ফিরতে মনে পড়তে লাগল রেহেমত্ আলির কথাগুলো। আর মনে পড়ল একটা লেখা ভাস্কর চক্রবর্তীর,
"কতো হাজার কোটি বছরের পর হঠাৎ এই জন্ম। --উনি আমার মা ছিলেন! তিনি বাবা; এই ভাই, বোন, দিদিরা! এই দু'একজন বন্ধু! --তারপর শুধুই মিলিয়ে যাওয়া। আবার হাজার হাজার কোটি বছরেও দেখা হবে না কারো সঙ্গে! এই রহস্য আমাকে আজ বড়ো কাছে ডাকছে। "
আমরা তো মিলিয়েই যাই এক অন্ধকারে, হাজার হাজার কোটি কোটি বছরের জন্য তবু এটুকু সময় কেন একসঙ্গে কাটাতে পারিনা আমরা সবাইকে নিয়ে। এ ও এক রহস্য... এক ইউনিভার্সাল মিস্ট্রি।


No comments:

Post a Comment