Thursday 1 November 2018

ডুয়ার্স সফরনামাঃ পাহাড় থেকে নদী, নদী থেকে পাহাড় - অতনু


অক্টোবর ২২, রাত ৮টা, জয়ন্তী 

রাত্রি আটটা। আমরা দুজন দুটো পাথরের ওপর বসে আছি। সামনে দিয়ে সরবে বয়ে চলেছে জয়ন্তী নদী। পা টাকে একটু সামনে ছুঁড়ে দিলে বা একটু ঝুঁকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেই জলের স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে। কোজাগরী লক্ষীপূর্ণিমার আগের দিন। আকাশে প্রায় পূর্ণ চন্দ্র। নরম জ্যোৎস্নার আলো ছেয়ে আছে নদীতট জুড়ে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে নদীর পেছনে ছায়া ছায়া পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে ক্যাঁও ক্যাঁও করে ময়ূরের ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু দূরে আরেকটা পাথরের ওপর বসে আছে তন্ময় আর শুক্লা। ওদের যুগল কন্ঠের ছেঁড়া ছেঁড়া সুর শুনতে পাচ্ছি ... তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই ...। পল্লব চুপ করে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বব আর অঞ্জনকে দেখতে পাচ্ছি না। ওরা বোধহয় নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেছে। পেছন থেকে অংশুমান বলল, "হামিন আস্ত-ও, হামিন আস্ত-ও, হামি আস্ত।" পৃথিবীর বুকে স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তো এখানেই। পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, গতকাল ঐগুলোরই কোন একটার মাথায় ছিলাম। লেপচাখা। কালকে পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখেছিলাম নদী কে। আজ নদীর ধারে বসে দেখছি পাহাড় কে।



লেপচাখায় দেখেছিলাম প্রকৃতির আরেক রূপ। আগেরদিন ছিলাম ২৮০০ ফুট উঁচুতে বক্সা ফোর্টের ধারে সূরয ড্রুকপার হোমস্টে তে। সেখান থেকে আরো ৭০০ ফুট চড়াই পাথুরে রাস্তা বেয়ে উঠতে উঠতে যখন ভাবছিলাম, এত কষ্ট করে কিইই বা পাব, তখনই একটা বৌদ্ধ স্তুপ আর অনেকগুলো টিনের চাল দেওয়া কাঠের বাড়ির আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন "ডুয়ার্সের রাণী।" ঠিক যেন একটা ওলটানো বাটির মাথায় এসে দাঁড়ালাম। সবুজ ঘাসের লনের ওপর পেমা ড্রুকপার কাঠের হোমস্টে। বাটির তিন ধারে গেলে দেখা যাবে ধাপে ধাপে জঙ্গল নেমে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। তারপর বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। তার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকগুলো নদী। অন্য ধারে আরো উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ঐ পাহাড় পেরোলেই ভূটান। আকাশে ধূসর মেঘ। মেঘের ফাঁক দিয়ে নরম রোদ্দুর এসে পড়ছে সবুজ ঘাসের ওপর। লেপচাখার মাঠে খেলবে বলে পল্লব কুড়ি টাকা দিয়ে একটা রবারের বল কিনেছিল। সেটা ওপর থেকে ফেলতেই পেমাজির একরত্তি ছেলে সেটা বগলদাবা করে ধাঁ। মাঠের ওপর চেয়ার টেবিল পেতে মধ্যাহ্নভোজের পর সবাই ঘরে গিয়ে নাসিকা সঙ্গীত শুরু করল। খালি আমি আর শ্রীরূপা হোমস্টের বারান্দায় বসে রইলাম। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন সূযযিমামা। ক্রমে তাঁরও বেলা বয়ে এলো। ধীরে ধীরে আকাশ রাঙা করে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে তিনি নামতে না নামতেই অন্যদিক দিয়ে উদয় হলেন চাঁদমামা। তারপর হোমস্টের বারান্দায় আড্ডা গল্প খেলা, পেমাজির স্ত্রীর করা মাংসের ঝোল আর ভাত দিয়ে নৈশাহার, তারপর আবার আড্ডা গল্প সেরে কখন ঘুমোলাম তা আর মনে পড়ে না।




অনির্বানের ফোনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। এবারে সশরীরে আসতে না পারলেও অনির্বান সবসময়েই আমাদের সঙ্গে আছে। বলল, বেশী রাত করিস না, এখানে বুনো হাতি বেরোতে পারে। আমরা উঠে পড়লাম। বব, অঞ্জন, অংশুমানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি পাঁচজন রওনা দিলাম প্রজাপতি হোমস্টে-র দিকে। সকালে লেপচাখা থেকে ট্রেক করে সাঁওতালবাড়িতে নেমে অসীমের গাড়িতে করে দুপুরবেলায় এখানেই এসে উঠেছি আমরা। হোমস্টের প্রোপাইটার কমল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সদা তৎপর, অতিথিদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়। বিকেলবেলায় নদীর ধারে বেরোচ্ছি শুনে মুড়ি, চানাচুর, ভেজ পকোড়া আর বড় কাপে কড়া করে চমৎকার লিকার চা খাইয়ে ছেড়েছেন। বব রা এলো খানিক পরে। ওরা নদীর ওপারে গিয়ে শুয়েছিল। তারপর কোন অচেনা জানোয়ারের ডাক শুনে পালিয়ে এসেছে। লাভের লাভ যেটা হয়েছে, অঞ্জন তার সদ্য কেনা হাওয়াই চটিটি নদী পেরোতে গিয়ে খুইয়ে এসেছে। সাধের টুপিটা সাঁওতালবাড়ির মোমোর দোকান থেকে উদ্ধার করতে পারলেও জয়ন্তী অতটা ভদ্র নয় বলাই বাহুল্য।



অক্টোবর ২৩, সকাল ৬টা, জয়ন্তী 

ভেবেছিলাম ভোরবেলায় নদীর ধারে চলে আসবো, সূর্যোদয়ের আগেই। কিন্তু গতরাত্রেও আগের দিনের মতই গল্প আড্ডায় শুতে দেরি হয়ে গেছে। সবাইকে ওঠানো গেল না। আমি, শ্রীরূপা আর অংশুমান যখন নদীর ধারে এলাম তখন ৬টা বেজে গেছে। সূযযিমামা পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঠে পড়েছেন। ভোরের আলোয় জয়ন্তী তার সৌন্দর্যকে মেলে দিয়েছে অন্য চেহারায়। নদী খাতের খুব বেশী হলে পাঁচ ভাগের একভাগ দিয়ে জল বইছে। নানা রঙের নুড়ি পাথর ছড়ানো। নদীর পেছনের পাহাড়, পাহাড়ের তলায় জঙ্গল এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নদীতীরে আর কেউ নেই। খালি একজন একটা বড় গাড়ি ধুচ্ছেন নদীর জলে। খানিক বাদে আরেকজন এসে নদীর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যবন্দনা শুরু করলেন। অংশুমান তার ক্যামেরা দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য লেন্সবন্দী করতে ব্যস্ত। আমরা পায়ে পায়ে নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম। কয়েকটা জিপসি দেখলাম যাত্রীসহ জলের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেল সাফারি করতে। ওদিকে তন্ময় শুক্লা চলে এসেছে। তন্ময় নুড়ি ওপর নুড়ি সাজিয়ে শিল্পরচনায় ব্যস্ত। আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ব্রেকফাস্ট করে জলদাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হব।

অক্টোবর ২৩, দুপুর ১২টা, জয়ন্তী পোখরি লেক 

আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি পোখরি লেকের ধারে। বব লেকের পাড়ে বসে মুঠো করে জলে মুড়ি ছুঁড়ে দিচ্ছে আর সেই মুড়ি খাওয়ার জন্য হাঁ করে ছুটে আসছে অজস্র মাগুর মাছ। হঠাৎ আমাদের গাইড গৌরাঙ্গ দে মহাশয় ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললেন। লেকের পাড়ের একটা গাছ উপড়ে ফেলা রয়েছে জলের ওপর। গাছের মূলের শেকড়ের দিকটায় অনেকটা মুড়ি ফেলা রয়েছে। আর গুঁড়ির যেখানটা জলে ডুবে আছে সেখান দিয়ে আস্তে আস্তে উঠছে একটা কচ্ছপ। কিন্তু এ কী! কচ্ছপটা উঠতে যেতেই আশপাশ থেকে কয়েকটা মাগুর মাছ তার পা টেনে ধরল। খানিক টানাটানির পর কচ্ছপটা গুঁড়ির ওপর উঠতে সমর্থ হল। পল্লব গম্ভীর মুখে ফিসিফিস করে বলল, "সার্ভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট"। গুটিগুটি পায়ে সে যখন মুড়ির কাছে এলো তখন প্রাণীবিদ অঞ্জন আর ডক্টর অংশুমান আবিষ্কার করল যে প্রাণীটার লিপ্তপদ নেই। অতএব এটা tortoise, turtle নয়। অঞ্জন বলল, "মাগুরমাছ, বা কচ্ছপ, মুড়ি কারোরই স্বাভাবিক খাদ্য নয়। মানুষ মুড়ি দিয়ে এদের অভ্যেস পালটে দিয়েছে।" গৌরাঙ্গবাবু আসার সময়েই বলছিলেন, এটা একটা ধর্মস্থান, পুজোর বেদী থাকলেও এখানকার আসল দেবতারা আছেন মৎস ও কূর্ম অবতার রূপে। ভূটান থেকে বৌদ্ধরা এসে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নানারকম খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে। কিন্তু মুড়ি ছাঁড়া কোনটাই এনাদের পেটে সহ্য হয় না। তাই অন্য খাবার দেওয়া এখন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। 



আজকের হাঁটাটা একেবারেই আনএক্সপেক্টেড ছিল। প্রজাপতি হোমস্টে থেকে বেরিয়ে অসীম যখন বলল জলদাপাড়া যাওয়ার আগে পোখরি লেক ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো, তখন ভেবেছিলাম গাড়ি থেকে নেমে লেক দেখে বেরিয়ে যাব। তা না হয়ে যখন চেকপোস্ট থেকে গাইড নিতে হল এবং সেই গাইড গৌরাঙ্গবাবু খানিক এগিয়েই বললেন এবার উঠতে হবে তখন গালে একগাল মাছি। যদিও লেপচাখা ট্রেক করে আসার পর এটা কিছুই না, তবু মানসিক প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে ফের ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে শুনতে, বুনো ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে, বাহারি প্রজাপতিদের লুকোচুরি দেখতে দেখতে পাহাড়ে উঠে পড়লাম। এখানে বুনো হাতি ও লেপার্ড আছে। লেপার্ড গরু ছাগলের খোঁজে গ্রামে হানা দিলেও মানুষকে তেমন ঘাঁটায় না। তবে গৌরাঙ্গবাবুর কথায় সবচেয়ে খতরনাক জানোয়ার হচ্ছে বুনো কুকুর বা ধোল। ৩৫ টা ঢোলের  একটা দল ঐ এলাকাতেই আছে। এদের কারোরই দেখা অবশ্যি মেলেনি। মাঝে বিপত্তি বলতে ছবি তুলতে গিয়ে অংশুমানের পপাত ধরণীতল হওয়া।

পোখরি লেক দেখে পাহাড় থেকে নেমে আবার অসীমের গাড়িতে বসলাম। এবার ফাইনালি ডেস্টিনেশন জলদাপাড়া।

 
 

প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরঃ

কমল বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রজাপতি হোমস্টে) - 9733341594/ 9002232665
দীপঙ্কর দে (ম্যাজেস্টিক হিমালয়ান) - 9733828481

বক্সা দুর্গ

বক্সা দুর্গ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এটা কারা তৈরী করেছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ভূটান ও কোচবিহার রাজ্যের সংঘাতের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই দুর্গ। ১৭৭২ সালে ভুটানরাজ বক্সাদুয়ার দিয়ে কোচবিহার আক্রমণ করলে কোচবিহারের রাজা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শরণাপন্ন হয়। ব্রিটিশ বাহিনী ভোটসেনা দের বিতাড়িত করলেও পরে তিব্বতের মধ্যস্থতায় ব্রিটিশরা বক্সার ওপর ভূটানের অধিকার মেনে নেয়। কিন্তু পরে ভূটান ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে বিরোধ ফের মাথাচাড়া দেয়। ১৮৬৩ তে ব্রিটিশ দূত ইডেন ভূটান রাজসভায় চূড়ান্ত লাঞ্ছিত হয়। পরের বছর দ্বিতীয় ভূটান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং কর্ণেল ওয়াটসনের নেতৃত্বে ইংরেজরা বক্সা দুর্গ সহ সমগ্র ডুয়ার্স দখল করে। ব্রিটিশরা বাঁশ ও কাঠের তৈরী কাঠামো ভেঙে ইঁট পাথর দিয়ে পুনর্গঠিত করে। বিংশ শতকে বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধাক্কায় অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশরা এই দুর্গে একটা বন্দীশালা বানায়। উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবীদের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দুর্গম পাহাড়ে নির্বাসন দেওয়া। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, নলিনীকিশোর গুহ, ত্রিদিব চৌধুরী, প্রমোদ দাশগুপ্ত সহ অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল, বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স ইত্যাদি গ্রুপের বহু বিপ্লবীকে এই দুর্গে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৩১এর ২৫শে বৈশাখ বক্সা দুর্গের রাজবন্দীরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেন এবং কবিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠান৷ রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাভিনন্দন জানিয়ে লিখে পাঠান,
"অমৃতের পুত্র মোরা" কাহারা শুনিল বিশ্বময়!
আত্মনিবেদন করি, আত্মারে কে জানিল অক্ষয়;
ভৈরবের আনন্দেরে
দুঃখেতে জিনিল কে রে,
বন্দীর শৃঙ্খলছন্দে মুক্তের কে দিল পরিচয়৷৷
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আগে গান্ধীজি দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন বন্দীদের সঙ্গে আলোচনা করতে৷ স্বাধীনতার পর নেহরু সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলে আবদুল হালিম, বিজয় মোদক, চারু মজুমদার, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সহ অনেক কমিউনিষ্ট সংগঠক এখানে অন্তরীত হন। ১৯৫১ সালে এই বন্দীশিবির বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৫৯ এ তিব্বতে দলাই লামার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর বেশ কিছু তিব্বতি শরণার্থী এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন অবশ্য শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তবে রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত বন্দীদের শুভেচ্ছাবার্তা আর রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাভিনন্দন দুটো পাথরের ফলকে খোদাই করা আছে৷

No comments:

Post a Comment